উত্তরাঞ্চলের বড় নদীর গভীরতা বেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রিত হবে। বছর বছর বন্যার পানি বৃদ্ধি এবং কমর সময় বসতভিটা, জমি-জিরাত যমুনার ভাঙ্গনের তোপের মুখে পড়ে হাজারো মানুষ নিস্ব হবে না। সকাল বেলার গেরস্ত সব হারিয়ে ফকির হবে না সন্ধ্যায়। ছোট নদীগুলো হারানো নাব্য ফিরে পেয়ে পূর্বের ¯্রােত রেখায় বয়ে যাবে। নদীর এই প্রবাহ গ্রামীণ জীবনের অর্থনৈতিক প্রবাহ বাড়িয়ে দেবে। বলা হয়, উত্তরাঞ্চলের মানুষ অবহেলিত (!)। সেই অবস্থা আজ আর নেই। সুষম উন্নয়নে দেশের উত্তরাঞ্চলে চোখ মেলে তাকিয়েছে আকাশপানে।
নদীমাতৃক এই দেশে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোকে স্বাভাবিক প্রবাহে ফিরিয়ে আনতে সরকার নদী রক্ষায় বহুমুখী কর্মসূচীর মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বৃহৎ এই প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন ২০১৮ সালের শেষভাগে। বাঙালী-করতোয়া-ফুলজোড়-হুরাসাগর নদী সিস্টেম ড্রেজিং পুনর্খনন ও তীর সংরক্ষণ নামের এই প্রকল্পে ব্যয়ের প্রাক্কলন হয়েছে দুই হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বৃহৎ এই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের প্রাথমিক সকল কাজ শেষ করেছে। গত বছর জানুয়ারি মাসেই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হয়েছে।
কর্মসূচী বাস্তবায়নের শুরুতেই করোনার থাবায় ভাটা পড়ে। তবে করোনাকালেও সরকারী পর্যায়ের ফাইল ওয়ার্ক সীমিত ভাবে চলতে থাকে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুটি পর্যায়ের নতুন একটি বিষয় সংযোজিত হয়েছে। তা হলো : নদীর গভীরতাকে চিরস্থায়ী করে নদীকে রক্ষা করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখা হবে। ড্রেজিংয়ের এই কাজটি করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এর আগে সারিয়াকান্দিতে যমুনায় রিভেটমেন্ট ও শক্তিশালী বাঁধের নির্মাণ কাজ করেছে সেনাবাহিনী। বৃহৎ এই প্রকল্পে নদীর গভীরতাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে ¯্রােতধারাকে বাড়িয়ে দিলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ভাঙ্গন দূর হবে। একজন পানি প্রকৌশলী জানান, এর আগে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে নদীর উৎসমুখ বন্ধ করে অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে তোলায় নদী নাব্য হারিয়েছে। তলদেশ ভরাট হয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ হয়েছে কখনও সরাসরি তীর ও চরগ্রাম ভেঙ্গেছে। কখনও স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা পেয়ে নদী ক্ষেপে গিয়ে ব্যাক ফ্লো করে আরও শক্তি সঞ্চয় করে কয়েকগুণ বেশি গতিতে তীর বসত ভিটা জমিজিরাত ভেঙ্গে দিয়েছে। এই অবস্থার পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সে জন্যই নদীর গভীরতা বাড়িয়ে দিতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ অন্যান্য ড্রেজিং করা হবে।
প্রকল্পের তীর সংরক্ষণের কাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তীর সংক্ষণের কাজের মধ্যেও নদী ড্রেজিংয়ের পর আনুষঙ্গিক যে কাজগুলো থাকে সেগুলো পাউবো করবে। এর মধ্যেও ভাঙ্গন প্রতিরোধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকবে। সব মিলিয়ে পাউবো পরবর্তী কাজগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে। যাতে বৃহৎ এই প্রকল্পটি অজেয় হয়ে থাকে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দ্রুত বাস্তবায়নের সার্বিক কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ড্রেজিং কাজের বিষয়টি নিয়ে শীঘ্রই সেনবাহিনীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে উভয় পক্ষ (পাউবো ও সেনাবাহিনী) কাজ বুঝে নেবে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বগুড়া, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জে মরা গাঙ্গে পরিণত হওয়া নদীর নাব্য ও গভীরতা বাড়িয়ে নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নের বহুমুখী ধারা গড়ে তোলা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে নদীগুলো অতীতের ¯্রােতধারা ফিরে পাবে। বর্তমান প্রজন্ম ছোট নদীগুলোর শুধু নামই শুনেছে। সেদিনের সেই প্রবাহ দেখেনি। খেয়াঘাট খেয়া পারাপার প্রজন্মের অচেনা। অথচ এই নদীকে ঘিরেই কৃষির সেচ কাজ, নদী পারাপারে পণ্য নিয়ে এক হাট থেকে আরেক হাটে গিয়ে বেচাকেনা হতো। এভাবে নদী কেন্দ্রিক কৃষি পণ্যের এই বিপণনে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে সাশ্রয়ী যোগাযোগে। এই খেয়াঘাট বা খেয়া পারাপারকে কেন্দ্র করে মিনি নৌবন্দর গড়ে ওঠে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট পানি বিজ্ঞানী জানান, প্রকল্প ঘিরে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে নৌবন্দর গড়ে তুলে চারপাশের এলাকায় উন্নয়ন কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে। এই প্রকল্পের অনেক আগে যমুনা তীরের সারিয়াকান্দি এলাকাকে নৌবন্দর রূপান্তরের একটি পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমান প্রকল্পের সঙ্গে এটিকে সংযুক্ত করার কথাও ভাবা হচ্ছে। দূর অতীতে বগুড়ার সারিয়াকান্দির সঙ্গে পাশর্^বর্তী জামালপুর জেলার সঙ্গে নৌপথে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ছিল।